বন্ধুরা এই লেখায় আলোচনা করব আমেরিকা কে আবিষ্কার করেছে এবং ক্রিস্টোফার কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কার এর ইতিহাস। আমেরিকা আবিষ্কারের ইতিহাস বিশ্বের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই ঘটনা শুধু একটি ভৌগোলিক আবিষ্কার নয়, বরং এটি সংস্কৃতি, বাণিজ্য এবং সভ্যতার মেলবন্ধনের সূচনা।
আমেরিকা আবিষ্কারের কৃতিত্ব সাধারণত ক্রিস্টোফার কলম্বাসের নামের সঙ্গে জড়িত, যিনি ১৪৯২ সালে ইউরোপ থেকে এই নতুন ভূখণ্ডে পৌঁছান। তবে, এই আবিষ্কারের পেছনে রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস, সাহসিকতা এবং কিছু বিতর্ক। এই লেখায় আমরা আমেরিকা আবিষ্কারের পটভূমি, কলম্বাসের অভিযান, তার প্রভাব এবং এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করব।
ক্রিস্টোফার কলম্বাস ছিলেন একজন ইতালীয় নাবিক এবং অভিযাত্রী, যার জন্ম হয় ১৪৫১ সালে ইতালির জেনোয়া শহরে। ছোটবেলা থেকেই তিনি সমুদ্রযাত্রার প্রতি গভীর আকর্ষণ অনুভব করতেন। সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ আর অজানা ১৫০০০ দ্বীপে ভ্রমণ করার স্বপ্ন তাকে অল্প বয়সেই নাবিক হিসেবে কাজ শুরু করতে উৎসাহিত করে। তিনি বিশ্বাস করতেন যে পৃথিবী গোলাকার, এবং পশ্চিম দিক দিয়ে সমুদ্রপথে ভারতের মতো পূর্বের দেশে পৌঁছানো সম্ভব। এই ধারণা তাকে একটি সাহসী অভিযানের পরিকল্পনা করতে প্ররোচিত করে।
কলম্বাস তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন রাজা-রানীর কাছে তহবিলের জন্য আবেদন করেন। অবশেষে স্পেনের রাজা ফার্দিনান্দ এবং রানী ইসাবেলা তার প্রস্তাবে সম্মত হন। তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় কলম্বাস তিনটি জাহাজ নিয়ে অভিযান শুরু করেন। তার এই সাহসিকতা এবং দৃঢ় বিশ্বাস তাকে ইতিহাসের পাতায় অমর করে রেখেছে।
ক্রিস্টোফার কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কার ইতিহাস
১৪৯২ সালের ৩ আগস্ট কলম্বাস তার অভিযান শুরু করেন। তিনি তিনটি জাহাজ সান্তা মারিয়া, নিনা এবং পিন্টা নিয়ে স্পেনের পালোস বন্দর থেকে যাত্রা শুরু করেন। তার মূল উদ্দেশ্য ছিল পশ্চিম দিক দিয়ে ভারতের একটি নতুন সমুদ্রপথ আবিষ্কার করা। তবে, তিনি জানতেন না যে তার এই যাত্রা তাকে একটি সম্পূর্ণ নতুন মহাদেশে নিয়ে যাবে।
দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার পর ১২ অক্টোবর ১৪৯২ সালে কলম্বাস বাহামা দ্বীপপুঞ্জের একটি দ্বীপে পৌঁছান। তিনি এই দ্বীপের নাম দেন “সান স্যালভাদর। তিনি ভেবেছিলেন, তিনি ভারতের কাছাকাছি কোনো দ্বীপে পৌঁছে গেছেন। এই কারণে তিনি স্থানীয় আদিবাসীদের ইন্ডিয়ান বলে ডাকতে শুরু করেন। যদিও তিনি আমেরিকার মূল ভূখণ্ডে পা রাখেননি, তার এই অভিযান ইউরোপীয়দের জন্য আমেরিকার দরজা খুলে দেয়।
কলম্বাসের সমুদ্রযাত্রা কোনো সহজ কাজ ছিল না। তিনি এবং তার সঙ্গীরা অসংখ্য চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন। দ`প্রথমত, তার পরিকল্পনাকে অনেকেই অবাস্তব বলে মনে করতেন। অনেক রাজা-রানী তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, কারণ তারা বিশ্বাস করতেন যে পশ্চিম দিক দিয়ে ভারতে পৌঁছানো অসম্ভব। তবে, কলম্বাস তার বিশ্বাসে অটল ছিলেন।
সমুদ্রযাত্রার সময় তারা খাবার এবং পানির অভাবের সম্মুখীন হন। দীর্ঘদিন ধরে শুধু সমুদ্র আর আকাশ দেখে নাবিকদের মধ্যে হতাশা ছড়িয়ে পড়ে। কিছু নাবিক এমনকি বিদ্রোহের পরিকল্পনাও করে। কিন্তু কলম্বাসের নেতৃত্বগুণ এবং দৃঢ় মনোবল তাদের একত্রিত রাখে। তিনি নাবিকদের উৎসাহ দিতেন এবং বলতেন যে তারা শীঘ্রই ভূমি দেখতে পাবেন। তার এই আশাবাদ অবশেষে সফল হয়, যখন তারা সান স্যালভাদরে পৌঁছান।
আমেরিকার আদিবাসী ও ইউরোপীয় সংঘর্ষ
যদিও কলম্বাস আমেরিকাকে আবিষ্কার করেছিলেন বলে ইতিহাসে উল্লেখ করা হয়, তবে এটি মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে আমেরিকায় হাজার হাজার বছর ধরে আদিবাসীরা বসবাস করছিলেন। এই আদিবাসীদের নিজস্ব সংস্কৃতি, ভাষা এবং জীবনধারা ছিল। কলম্বাস যখন তাদের সঙ্গে প্রথম দেখা করেন, তিনি তাদের সৌজন্যমূলক এবং অতিথিপরায়ণ হিসেবে বর্ণনা করেন। তবে, ইউরোপীয়দের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে আদিবাসীদের জীবনে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে।
ইউরোপীয়রা আমেরিকায় উপনিবেশ স্থাপন শুরু করে। এই উপনিবেশগুলো প্রতিষ্ঠার সময় আদিবাসীদের সঙ্গে সংঘর্ষ, রোগ এবং শোষণের ঘটনা ঘটে। ইউরোপীয়রা তাদের সঙ্গে এমন কিছু রোগ নিয়ে আসে, যার বিরুদ্ধে আদিবাসীদের কোনো প্রতিরোধ ক্ষমতা ছিল না। ফলে, লাখ লাখ আদিবাসী মারা যায়। এই ঘটনা ইতিহাসে একটি বেদনাদায়ক অধ্যায় হিসেবে রয়ে গেছে।
আমেরিকার নামকরণ
কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করলেও, এই মহাদেশের নাম তার নামে রাখা হয়নি। আমেরিকার নামকরণ করা হয় ইতালীয় ভূগোলবিদ আমেরিগো ভেসপুচির নামানুসারে। ভেসপুচি কলম্বাসের পরবর্তী সময়ে আমেরিকায় ভ্রমণ করেন। তিনি বুঝতে পারেন যে কলম্বাস যে ভূমিতে পৌঁছেছিলেন, সেটি ভারত নয়, বরং একটি সম্পূর্ণ নতুন মহাদেশ।
১৫০৭ সালে জার্মান মানচিত্রশিল্পী মার্টিন ওয়াল্ডসিমুলার একটি নতুন মানচিত্র তৈরি করেন। তিনি ভেসপুচির বর্ণনার উপর ভিত্তি করে এই নতুন মহাদেশের নাম রাখেন আমেরিকা। এই নাম ধীরে ধীরে সারা বিশ্বে গৃহীত হয়।
কলম্বাসের জাহাজ এবং তাদের বৈশিষ্ট্য
কলম্বাসের অভিযানে ব্যবহৃত তিনটি জাহাজ সান্তা মারিয়া, নিনা এবং পিন্টা—ইতিহাসে বিখ্যাত।
জাহাজের নাম | আকার | ক্রু সংখ্যা | বিশেষত্ব |
---|---|---|---|
সান্তা মারিয়া | বড় | প্রায় ৪০ | কলম্বাসের প্রধান জাহাজ, পরে ধ্বংস হয় |
নিনা | ছোট | প্রায় ২৫ | দ্রুতগামী এবং ক্ষিপ্র |
পিন্টা | ছোট | প্রায় ২৫ | নির্ভরযোগ্য এবং শক্তিশালী |
সান্তা মারিয়া ছিল তিনটি জাহাজের মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং কলম্বাস নিজে এটি পরিচালনা করতেন। তবে, এই জাহাজটি হাইতির কাছে একটি প্রবালপ্রাচীরে আটকে যায় এবং ধ্বংস হয়। নিনা এবং পিন্টা ছোট হলেও এগুলো দ্রুত এবং সমুদ্রযাত্রার জন্য উপযুক্ত ছিল। এই জাহাজগুলোর নকশা এবং গঠন তৎকালীন সময়ের সমুদ্রযাত্রার প্রযুক্তির একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কার বিশ্বের ইতিহাসে একটি টার্নিং পয়েন্ট। এই আবিষ্কারের ফলে ইউরোপ এবং আমেরিকার মধ্যে একটি নতুন সংযোগ স্থাপিত হয়। এটি বাণিজ্য, সংস্কৃতি এবং জ্ঞানের বিনিময়ের একটি নতুন যুগের সূচনা করে। ইউরোপীয়রা আমেরিকা থেকে আলু, টমেটো, ভুট্টা এবং চকোলেটের মতো নতুন ফসল এবং খাবারের সঙ্গে পরিচিত হয়। একইভাবে, আমেরিকায় ইউরোপীয়রা ঘোড়া, গবাদি পশু এবং ধাতব অস্ত্রের মতো জিনিসপত্র নিয়ে আসে।
তবে, এই বিনিময়ের নেতিবাচক দিকও ছিল। ইউরোপীয় উপনিবেশ স্থাপনের ফলে আদিবাসীদের জমি দখল, শোষণ এবং সাংস্কৃতিক ধ্বংসের ঘটনা ঘটে। এছাড়া, দাসপ্রথার প্রসার ঘটে, যেখানে আফ্রিকা থেকে লাখ লাখ মানুষকে জোর করে আমেরিকায় নিয়ে আসা হয়। এই ঘটনাগুলো মানব ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায় হিসেবে রয়ে গেছে।
কলম্বাসের উত্তরাধিকার এবং বিতর্ক
কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের উত্তরাধিকার নিয়ে আজও বিতর্ক রয়েছে। একদিকে, তাকে একজন সাহসী অভিযাত্রী হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যিনি বিশ্বের দুটি অংশকে একত্রিত করেছেন। তার অভিযান ছাড়া আধুনিক বিশ্বের অনেক কিছুই সম্ভব হতো না। অন্যদিকে, তার আগমনের ফলে আদিবাসীদের উপর যে অত্যাচার এবং ধ্বংস নেমে আসে, তা অনেকেই সমালোচনা করেন। কলম্বাসের নামে অনেক জায়গায় ছুটি পালিত হয়, যাকে “কলম্বাস ডে” বলা হয়। তবে, কিছু অঞ্চলে এই দিনটিকে আদিবাসী দিবস হিসেবে পালন করা হয়, যাতে আদিবাসীদের ইতিহাস এবং সংস্কৃতির প্রতি সম্মান প্রকাশ করা হয়।
ক্রিস্টোফার কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কার বিশ্ব ইতিহাসের একটি অমর কাহিনি। তার সাহস, দৃঢ়তা এবং দূরদর্শিতা একটি নতুন যুগের সূচনা করে। তবে, এই আবিষ্কারের ফলে যে ইতিবাচক এবং নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে, তা আমাদের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে ধারনা দেয়। আমেরিকা আবিষ্কারের গল্প শুধু একটি অভিযানের গল্প নয়, এটি মানব সভ্যতার অগ্রগতি, সংঘর্ষ এবং একত্রীকরণের গল্প।
শিক্ষা নিউজে শিক্ষা সম্পর্কিত সঠিক তথ্যের আপডেট সবার আগে জানতে শিক্ষা নিউজের সোসাল হ্যান্ডেলগুলো অনুসরণ করুন।
Discover more from Shikkha News | শিক্ষা নিউজ
Subscribe to get the latest posts sent to your email.