২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। এই আন্দোলনে যারা জীবন উৎসর্গ করেছেন এবং যারা আহত হয়েছেন, তাদের পরিবারের প্রতি সম্মান জানাতে গুচ্ছভুক্ত ১৯টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি প্রক্রিয়ায় বিশেষ সুবিধা ঘোষণা করেছে। এই সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র শিক্ষার ক্ষেত্রে নয়, বরং সমাজে সাম্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার একটি পদক্ষেপ। এই প্রবন্ধে আমরা এই বিশেষ সুবিধার বিস্তারিত আলোচনা করব।
জুলাই অভ্যুত্থানের শহীদ ও আহত পরিবারের জন্য গুচ্ছ ভর্তিতে বিশেষ সুবিধা
গুচ্ছ ভর্তি বা Cluster Admission বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য একটি সমন্বিত ভর্তি পদ্ধতি। এই পদ্ধতির মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা একটি কেন্দ্রীভূত পরীক্ষার মাধ্যমে ১৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পান। ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে এই পদ্ধতির মাধ্যমে ভর্তি প্রক্রিয়া আরও সুবিন্যস্ত করা হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীদের জন্য বিভিন্ন ধরনের কোটা রাখা হয়েছে, যার মধ্যে জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানসংক্রান্ত বিশেষ সুবিধা অন্যতম।
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছে। এই আন্দোলনে অংশ নিয়ে অনেকে জীবন দিয়েছেন, অনেকে আহত হয়েছেন। গেজেটভুক্ত শহীদ এবং তালিকাভুক্ত আহত ব্যক্তিদের ত্যাগকে সম্মান জানাতে সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিশেষ পদক্ষেপ নিয়েছে। এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে তাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য ভর্তিতে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে।
বিশেষ সুবিধার বিবরণ
গুচ্ছভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ‘সমন্বিত ভর্তি নির্দেশিকা’ অনুযায়ী, জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে গেজেটভুক্ত শহীদ ও তালিকাভুক্ত আহত ব্যক্তিদের স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে, এবং তাদের অবর্তমানে ভাই-বোন ভর্তিতে বিশেষ সুবিধা পাবেন। এই সুবিধার আওতায় শিক্ষার্থীরা গুচ্ছভুক্ত ১৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য আবেদন করতে পারবেন। তবে, এই সুবিধার নির্দিষ্ট ধরন এবং প্রকৃতি সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের সঙ্গে আলোচনা করে সরকারের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
গুচ্ছভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ
গুচ্ছভুক্ত ১৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা নিম্নরূপ:
- ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
- মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, টাঙ্গাইল
- পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পটুয়াখালী
- নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, নোয়াখালী
- জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ
- যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, যশোর
- বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর
- পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা
- গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ
- বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল
- রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, রাঙামাটি
- রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, সিরাজগঞ্জ
- গাজীপুর ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি, গাজীপুর
- নেত্রকোনা বিশ্ববিদ্যালয়, নেত্রকোনা
- জামালপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জামালপুর
- কিশোরগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়, কিশোরগঞ্জ
- চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চাঁদপুর
- সুনামগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সুনামগঞ্জ
- পিরোজপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পিরোজপুর
এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির জন্য শিক্ষার্থীদের বিভাগ পছন্দক্রম নির্ধারণ করে অনলাইনে আবেদন করতে হবে।
ভর্তি প্রক্রিয়ার সময়সূচি
২৯ মে, ২০২৫ থেকে গুচ্ছ ভর্তির জন্য অনলাইন আবেদন শুরু হয়েছে। আবেদন প্রক্রিয়া চলবে ৫ জুন, ২০২৫ রাত ১১:৫৯ পর্যন্ত। শিক্ষার্থীদের এই সময়ের মধ্যে তাদের পছন্দের বিভাগ নির্বাচন করে আবেদন সম্পন্ন করতে হবে। এই প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ অনলাইনে সম্পন্ন হবে, যা শিক্ষার্থীদের জন্য সুবিধাজনক এবং সময়সাশ্রয়ী।
কোটা ব্যবস্থা
গুচ্ছ ভর্তি নির্দেশিকায় বিভিন্ন ধরনের কোটা উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে:
- মুক্তিযোদ্ধা কোটা
- প্রতিবন্ধী বা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন কোটা
- ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী/উপজাতি কোটা
- জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানসংক্রান্ত বিশেষ সুবিধা
- বিকেএসপি/খেলোয়াড় কোটা
- পোষ্য কোটা
- হরিজন ও দলিত কোটা
- নন-ট্রাইবাল কোটা (রাঙামাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রযোজ্য)
এই কোটাগুলোর মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিশ্চিত করছে যে সমাজের বিভিন্ন স্তরের শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাবেন।
বিশেষ সুবিধার তাৎপর্য
জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে শহীদ ও আহত ব্যক্তিদের পরিবারের জন্য বিশেষ সুবিধা প্রদানের সিদ্ধান্ত একটি মানবিক পদক্ষেপ। এই সুবিধা শুধুমাত্র শিক্ষার সুযোগ বাড়ানোর জন্য নয়, বরং সমাজে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের একটি মাধ্যম। মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আনোয়ারুল আজীম আখন্দ বলেছেন, “সরকারের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী আমরা এই সুবিধা প্রদান করছি। এটি শুধুমাত্র এই শিক্ষাবর্ষের জন্য প্রযোজ্য।” তিনি আরও জানান, এই সুবিধার ধরন নির্ধারণে উপাচার্যদের সঙ্গে আলোচনা চলছে।
গুচ্ছভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) গত ২৬ মে ঘোষণা করেছিল যে, তাদের স্নাতক প্রথম বর্ষের ভর্তিতে জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ ও আহত ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা বিশেষ সুবিধা পাবেন। এই ঘোষণা গুচ্ছভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
এই বিশেষ সুবিধা শিক্ষার্থীদের জন্য উচ্চশিক্ষার দ্বার উন্মোচন করবে। যারা জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে তাদের প্রিয়জনকে হারিয়েছেন বা যাদের পরিবারের সদস্যরা আহত হয়েছেন, তাদের জন্য এটি একটি নতুন আশার আলো। এই পদক্ষেপ সমাজে ন্যায়বিচার ও সমতার বার্তা ছড়িয়ে দেবে।
ফাইনাল কথা
গুচ্ছ ভর্তিতে বিশেষ সুবিধা শুধু একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত নয়, এটি একটি মানবিক প্রতিশ্রুতি। জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতদের পরিবারের প্রতি এই সম্মান প্রদর্শন বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার একটি নতুন মাইলফলক।
শিক্ষা নিউজে শিক্ষা সম্পর্কিত সঠিক তথ্যের আপডেট সবার আগে জানতে শিক্ষা নিউজের সোসাল হ্যান্ডেলগুলো অনুসরণ করুন।
Discover more from Shikkha News | শিক্ষা নিউজ
Subscribe to get the latest posts sent to your email.